Powered By Blogger

Monday, March 30, 2020

DARMA VALLEY TREK

ডারমা উপত্যকা  | DARMA VALLEY

পঞ্চচুল্লি মূল শিবির | PANCHACHULI BASECAMP

MAY 2014



ট্রেক মঙ্গার্স দলের সদস্যরা : অম্বিকা, কাকলি, বিশ্বরূপ, শাম্ব, সুদীপ, মাধব, কৌস্তভ, তরুণ, শঙ্খ এবং কিজার।


ডারমা উপত্যকা কুমায়ুন হিমালয়ে অবস্থিত একটি অতি মনোরম এবং বৈচিত্র পূর্ন স্থান। এর পূর্ব দিকে নেপাল এবং উত্তরে তিব্বত। বুঝতে আরেকটু  সুবিধা হবে যদি বলি মুন্সিয়ারি পঞ্চচুল্লির যেপারে, ডারমা হলো ঠিক তার অপর পারে। পঞ্চচুল্লির উপর সূর্যাস্তের শোভা দেখতে হলে মুন্সিয়ারি এবং সূর্যোদয় এর শোভা দেখতে হলে আপনাকে ডারমা উপত্যকার পঞ্চচুল্লি মূলশিবিরে যেতে হবে। 

০৯-০৫-২০১৪:

২০১৪ এর মে মাসে আমরা ১০ জনের দল লালকুঁয়া এক্সপ্রেস ধরে রওনা দিলাম ডারমা উপত্যকার উদ্দেশ্যে। লখ্য পঞ্চচুল্লি মূলশিবির। বলে রাখি, আমার স্ত্রী কাকলি  কে এই প্রথম ট্রেক এ নিয়ে যাচ্ছি।  লম্বা রেল যাত্রা, সবাই মিলে গল্প, গান, এটাসেটা খেয়ে কেটে গেলো।



১০-০৫-২০১৪:

লালকুঁয়া তে নেমে তাড়াতাড়ি মালপত্তর নামিয়ে একটা বড়ো টেম্পো ট্রাভেলার ঠিক করা হলো, কারণ আমাদের দল বড়ো আর সরঞ্জাম ও অনেক। কিছু পেটে দিয়ে দুগ্গা বলে গাড়ি ছাড়া হলো।আজ আমরা ধারচুলা দেহাত এ যাবো। বেশ কিছুটা যাবার পর বুঝতে পারলাম আমাদের যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে বেরোতে এবং একটা বেয়ারা সময়ে ধারচুলা পৌছাবো।  ৩০০ কিলোমিটারের লম্বা রাস্তা। ১০ ঘন্টা সময় তো লাগবেই! সূয্যিমামাও পাটে গেলেন। গাড়ি চলছে তো চলছেই! রাত হয়ে গেলো। প্রায় রাত ১১ টার সময় একটা সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট এ গাড়ি দাঁড়করিয়ে দিলো। বললো আগে যাওয়া যাবে না! আমাদের তো মাথায় বাড়ি! কারণ জিজ্ঞেস করাতে জওয়ান বললেন রাস্তা সামনে খুব খারাপ। ঝুঁকি হয়ে যাবে! আমরা তো নাছোড়বান্দা। বললাম ঝুঁকি আমাদের নিতে আপত্তি নেই। তখন তিনি বললেন তাহলে লিখে সই করে দিন সবাই মিলে।  তাই করে দিলাম। 

গাড়ি আবার ছাড়লো। অনুপম দক্ষতার সঙ্গে সেই বড়ো গাড়ি চালিয়ে চালক আমাদের সেই বিপদ জনক রাস্তা পার করালেন। যেরকম ভেবেছিলাম, রাত ১২:৩৫ এ একটা বেয়ারা  সময়ে পৌঁছলাম ধারচুলা। পৌঁছে তো গেলাম, কিন্তু থাকবো কোথায়? সব কিছুই তো নিস্তব্ধ! হঠাৎ দেখি একটা গাড়ি আর দুটো বাইক নিয়ে কারা যেন আসছে দূর থেকে! আমরা একটু অবাক হলাম! এতো রাত্রে এরকম জায়গায় এরা বাইক নিয়ে ঘুরছে কেন!? আমরা তো জানতাম না আসলে ওনারা দেবদূত! আমরা যে হোটেল টার নিচে দাঁড়িয়ে অনেক ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়া না পেয়ে কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তারা সেখানেই এসে দাঁড়ালেন এবং নেমে এসে ঘড়ঘড় করে সাটার টা খুলে দিলেন গাড়ি এবং বাইক ঢোকাবেন  বলে। আমরা জিজ্ঞেস করলাম 'রুম মিলেগা?', একজন দেবদূত বললেন 'হাঁ, মিলেগা ', আহা কি সৌভাগ্য! তাড়াতাড়ি তিনটে ঘর নিয়ে ঢুকে পড়লাম। ভাগ্যিস কিছু মানুষের অদ্ভুতুড়ে শখ হয়, নাহলে কেনই বা রাত্রে কেউ বাইক নিয়ে ঘুরবে আর আমরা তাদের সৌভাগ্য বসত পেয়েও যাবো! হোটেলে ঢুকে আমরা ভাবছি এবার আবার রান্না করতে হবে.. আর ঠিক তক্ষনি আরেকটি দেবদূতের আবির্ভাব। তিনি এসে আমাদের শুধালেন - 'ডিনার মে ক্যায়া চাহিয়ে স্যার?'.. আমরা তো আপ্লুত! বললাম কিছু তেমন করতে হবেনা ভাই.. আমাদের কাছেই সবকিছু আছে, আপনি শুধু একটু খিচুড়ি চাপিয়ে দিন। তেমনি হলো।  আমরা স্নান সেরে খেয়ে যখন শুতে গেলাম তখন রাত ৩ প্রহর। 


যাবার পথে Lunch break 


১১-০৫-২০১৪:

আগের দিন, 'থুড়ি' রাত তিনটে তে শুয়ে সকাল আটটায় উঠে পড়তে হলো।  অনেক কাজ আছে। অনুমতি পত্র, কেরোসিন, ঘোড়া, কাঁচা সব্জি সবকিছুর ব্যবস্থা করতে হবে। যদিও ঘোড়া  টা ধারচুলায় সম্ভব নয়। বাকি জিনিস গুলো কিনে নিয়ে এবং অনুমতি পত্রে সরকারি সিলমোহর নিয়ে আমরা দুটো গাড়ি ঠিক করলাম। আগামী কাল  আমরা যাবো সোবলা হয়ে দার নামের একটি গ্রামে। টুকটাক কিছু জিনিস কিনে নিলাম আমরা ধারচুলায়। গতকাল রাত্রে অন্ধকারে  কিছু ভালো ভাবে বোঝা যায়নি জায়গা টার বিষয়ে। দিনের আলোতে দেখলাম বেশ জমজমাট জনপদ এই ধারচুলা। পাশেই বয়ে চলেছে কালিগঙ্গা নদী।  নদীর অপর পারেই নেপাল। আজ আমরা ধারচুলাতেই থাকবো। সকালে বেরোতে হবে দারের উদ্দেশ্যে।





টুকিটাকি কেনাকাটা


অনুমতি পত্র পাওয়ার অপেক্ষা 

১২-০৫-২০১৪

সকালে খাবার খেয়ে আমরা গাড়িতে মালপত্র চাপিয়ে রওনা দিলাম 'দার' এর উদ্দেশ্যে। গাড়ি নিয়ে যতো এগোচ্ছি, তত দেখছি চালক সাহেব গাড়ির সামনে দেখার থেকে রাস্তার ডান দিকে  নদীখাতের দিকে বেশী চেয়ে দেখছেন! আমরা বললাম 'আপ তো ইয়েহি কে হ্যায়, বাহার ইতনা ক্যায়া দেখরাহেহে? সামনে দেখকর চালাইয়ে!', উত্তরে চালক সাহেব বললেন 'আবগাহ কে এক সাল বাদ ইস রাস্তে পে আয়া, ইয়াহাঁ গাঁও থা.. এসএসবি ক্যাম্প থা.. সবকুচ বহে গ্যায়া! ' আমরা শুনে অবাক এবং দুঃখিত হলাম! কেদারনাথ এর খবর মানুষ শুনেছে, কারণ কেদারনাথ বহুল প্রচলিত একটি যাত্রাপথ। কিন্তু যেহেতু এই রাস্তায় কম অভিযাত্রী আসেন সেই কারণে এখানকার খবর কেউ পায়নি। অবশ্য পরে জানতে পেরেছিলাম যে এর জন্য তেমন কোনো প্রাণনাশ এর ঘটনা ঘটেনি ! কারণ 'আবগাহ' অর্থাৎ ক্লাউড বার্স্ট  এর ঘটনা দিনের বেলায় হওয়াতে এবং পূর্বেই সতর্কীকরণের কারণে বহু মানুষ নিরাপদ জায়গা তে স্থানান্তরিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে যান। 

গাড়ি চলতে থাকে। একটা জায়গা আসে যেখানে খানিকটা জলধারা পেরিয়ে বেশ খাড়া একটা ঢাল বেয়ে আমাদের গাড়ি কে উঠতে হবে।  কিন্তু আমাদের চালক সাহেব তার আগেই রণে ভঙ্গ দিয়ে বসলেন! বললেন এই জায়গা দিয়ে আমার গাড়ি যেতে পারবে না.. ডাবল ডিফেন্সিয়াল ইঞ্জিন নেই ওর গাড়িতে! আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো! বলে কি!? এর পরের রাস্তা তাহলে যাবো কিভাবে!? অথচ আমাদের আরেকটা গাড়ি সেই জায়গা অবলীলাক্রমে পার করে বেরিয়ে গেছে আমাদের আগেই! বচসা শুরু হলো! এখানেও বাঁচালেন আরেকজন দেবদূত। তিনি আবির্ভুত হলেন একটি মাহিন্দ্রা ম্যাক্সি ট্রাক এ। জানতে পারলাম তিনি ওখানের ভেঙে যাওয়া রাস্তা তৈরির/মেরামতের  কাজের চিফ ইঞ্জিনিয়ার এর রূপ ধরে রয়েছেন। আমাদের বিপদ দেখে বললেন তার গাড়ির ডালায় উঠে যেতে আমাদের আপত্তি নেই তো! আমরা বললাম, এ তো আমাদের পরম সৌভাগ্য! উঠে পড়লাম। দড়াম দড়াম করে ঝাকুনি খেতে খেতে পৌঁছে গেলাম দারের কাছে। নেমে দেখি রাস্তা মেরামতের কাজ পুরো দমে চলছে। সেই রাস্তা পার হয়ে খানিকটা এগিয়ে যা দেখলাম, সেটার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না!

দেখি দার '০ কিমি' লেখা মাইলস্টোন তার পরের থেকে আর রাস্তা নেই! উধাও হয়ে গেছে! রাস্তার খানিকটা আগে কয়েকটা মিলিটারি ট্রাক নাকি গত এক বছর ধরে ওখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে! তার দায়িত্বে থাকা জওয়ান রাও সেখান থেকে নড়তে পারেনি! রাস্তা মেরামত শেষ হলে তারা আবার ফিরতে পারবে। একজন দেখলাম মিদনাপুরের ছেলে। বাঙালী পেয়ে কথা বলে বাঁচলো। এবার আসি আমাদের বিপদের কথায়! রাস্তা তো আর নেই! একটা ড্রেজার দেখি নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কাজে লেগে আছে। এক দিক থেকে পাথর তুলছে আর আরেকদিকে পাথর ফেলছে। নদীর জল এর যা গভীরতা, তাতে ঘোড়া পার হতে পারবে না! অথচ আমাদের আজই ট্রেক শুরু করার দরকার! আর তা ছাড়া ঘোড়াও তো জোগাড় করতে হবে! কিন্তু গ্রামে লোক কোই? যাও লোক ছিলো , তারা সব 'কীড়া ঘাস' (এটার বিবরণ পরে দিচ্ছি) তুলতে চলে গেছে! একটা মাত্র ছোট্ট দোকান ছিলো ওখানে, আমরা তার থেকেই সব তথ্য পেলাম। তিনি শেষ পর্যন্ত একজন ঘোড়া ওয়ালা জোগাড় করে দিলেন। কিন্তু ঘোড়া পেলেই আর এগোতে পারছি কই?! নদীর জল তো অনেক গভীর। এরমধ্যে অম্বিকা, শাম্ব, কাকলি আর আমি পাহাড়ের ওপর দিকের একটা বিপদজনক রাস্তা দিয়ে গিয়ে ওই পাড়ের পাহাড়ে ঘুরে এলাম। বুঝলাম নদীটা পার হতে পারলে নিচের রাস্তা দিয়ে হেঁটে বাকিটা খুব কঠিন কিছু হবে না। 

যাইহোক, আজ যে বেরোনো যাবেনা সেটা বুঝে গেলাম। অগত্যা তাঁবু ফেলতে হবে! একটা ভাঙা বাড়ির ছাদে তাবু ফেললাম, কারণ আর কোথাও সমতল স্থান ই পাওয়া গেলো না ক্যাম্প করার মতো! সেখানেও কপাল খারাপ! তুমুল ঝড় বৃষ্টি নামলো। তাঁবু ফেলার সময়েই এমন অবস্থা হলো, যে ঠিক করলাম এই অবস্থায় তাবু খাটানোর পরিকল্পনা বাতিল করে ওই ভাঙা বাড়ির ভেতরেই আশ্রয় নেওয়া সমীচীন হবে! যেমন ভাবা, তেমন কাজ।  সব মাল পত্র নিয়ে ঢুকে পড়লাম পরিত্যক্ত বাড়ির ঘরে। ঢুকে দেখি ভিতরে জায়গা অনেকটাই আছে, সবাই শুতে পারবো। খারাপ লাগলো এই বাড়ির গৃহস্থ দের কথা ভেবে! এখনো দেওয়ালে ঠাকুরের ছবি ঝোলানো! তার ই কৃপায় তারা প্রাণে তো বেঁচে গেছে! যাইহোক, সন্ধ্যা হলে আমরা রান্নার ব্যবস্থা করলাম। সয়াবিন দিয়ে খিচুড়ি বানালো কাকলি ও তরুণ মিলে, আর তার ওপর মাখন। পেট ভরে খেয়ে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকলাম কাল যদি নদীর গভীরতা টা ওই ড্রেজার দিয়ে কমিয়ে ফেলতে পারে, তাহলে আমরা তাড়াতাড়ি হাঁটা শুরু করে দিতে পারি! এই নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম।


এভাবেই ভেঙে গেছিলো  নদীর পাড়ে সবকিছু 

কত্তা গিন্নী  :)

গাড়ির ডালায় বাকি পথ তা গেলাম 

দ্বার গ্রাম এ ঢোকার পর 

নদী বক্ষ ছাড়া এটাই যাতায়াতের পথ

নদী বক্ষ ছাড়া এটাই যাতায়াতের পথ

রাতের খাবার তৈরী করা হচ্ছে 


১৩-০৫-২০১৪: 

সুপ্রভাত, সত্যিই সুপ্রভাত! সকালে উঠে নদীর পারে গিয়ে দেখলাম ড্রেজার চালক দক্ষতার সাথে কাজ করে নদীর জায়গা টা অনেকটাই অগভীর করে ফেলেছেন। জিজ্ঞেস করে জানলাম আর ২-৩ ঘন্টার মধ্যেই ঘোড়া যাতায়াতের উপযুক্ত হয়ে যাবে জায়গাটি। তাড়াতাড়ি নুডলস দিয়ে ব্রেকফাস্ট টা সেরে নিলাম। ঘোড়াওয়ালা-ও এসে খবর নিয়ে চলে গেল ঘোড়া আনতে । সব মালপত্র গোছগাছ করে নিলাম আমরা। নদীর জল এখন কমে গেছে। নদীকে  অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার কাজে অনেকটাই সফল হয়েছেন ড্রেজার চালক। আমরাও ঘোড়ার পিঠে মালপত্র চাপিয়ে পিঠে sack নিয়ে নদীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাদের দেখে ড্রেজার চালক দাদা বললেন - 'ইসমে চড় জাইয়ে, পার কিযে দেতে হ্যায়'.. আমরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করে উঠে পড়লাম ড্রেজারের ওপরে! বাপরে-বাপ্! কড়মড়-কড়মড় করে মাটি পাথর যেন গুঁড়োতে গুঁড়োতে ড্রেজার চললো নদী পেরিয়ে। ওপারে পোঁছে গেলাম। কিন্তু উঠে দাঁড়াতে পারছি না! পিঠের sack টা এতো ভাড়ি লাগছে কেন!? পেছনে ফিরে দেখি শঙ্খ আমার sack ধরে ঝুলে আছে আর বলছে - 'আমাকে বাঁচা, আমি জলে পরে যাচ্ছি!' আমি বললাম ওরে আমরা ডাঙায় উঠে গেছি! নেমে পর, তুই জলে পড়বি না! একটু খিল্লি করে আমরা এবার হাঁটা শুরু করলাম। আমাদের ঘোড়া গুলো ও অতি সহজেই নদী পার হয়ে গেলো।  দেখলাম ওপরে থাকা বহু গ্রামবাসি আমাদের সাথেই হাঁটা শুরু করলো বাচ্চা, বয়স্ক মানুষ, পালিত গরু, কুকুর সবাই মিলে। বুঝলাম তারা ঘরে ফিরছে বহুদিন পর।  আরো বুঝলাম ২০১৩ এর  আবগাহের পরে আমরাই এই পথে প্রথম trek করতে আসলাম পথে।

আমাদের আজকের গন্তব্য ঊর্থিং নামের একটি গ্রাম। রাস্তাঘাট ভেঙে যাওয়ায় দূরত্বের মাপকাঠির ও কোনো বালাই নেই। যেটুকু জানলাম তাতে বোঝাগেল পথ এর দূরত্ব স্বাভাবিক ভাবেই বেড়ে গেছে। দার এর পর এর রাস্তাটি খানিকটা অবধি ভাঙাচোরা হলেও একটা জায়গার পর বেশ সুন্দর।পথে বংলিং নামের একটি গ্রাম থেকে আমাদের গাইড ভূপেন্দ্র আমাদের সাথে যোগ দিলো। দার এর ওই ছোট্ট দোকানের মালিক আমাদের ওর সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলো।  যেখান থেকে trail বা হাঁটাপথ শুরু হলো, সেখানথেকেই প্রকৃতির রূপ অনেকটাই পরিবর্তিত হতে শুরু করল। চড়াই উথরাই পথ ধরে চলতে থাকলাম। এরপর ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হলো।  Poncho  বের করে গায়ে দিলাম। সবুজ পাহাড়ের কোল দিয়ে যেতে যেতে একটা উথরাই এর কাছে আসতেই দেখলাম অনেকটা ওপরের দিক থেকে একটা ঝর্ণার জল ঝরে পড়ছে প্রায় পথের ধার ঘেঁষে। গায়ে Poncho না থাকলে ভিজিয়ে দেবে। আমার অপার্থিব লাগলো জায়গাটা। একটু Video তুলে নিলাম। এরপর আর কিছুক্ষন এগোতেই আমরা পৌঁছে গেলাম ঊর্থিং গ্রাম এ। গ্রাম টি চারদিকে উঁচু পাহাড়ে ঘেরা একটু সমতল জায়গায়। ঘর কয়েকটা মাত্র। ঊর্থিং এ একটা ধাবা মতো আছে।  সেখানেই একটা ঘরে আমাদের থাকার বন্দোবস্ত হয়ে গেলো। ধাবার সামনের জমির পরেই নিচের দিকে নদী। নদীর ওপারের পাহাড়ে কিছু Ibex এর দেখা পেলাম। সন্ধ্যায় তেল দিয়ে মুড়ি-চানাচুড় মাখা হলো। তারপর গল্প আর আড্ডা। রাত্রে আহারান্তে নিদ্রা। কিন্তু ঘুম আসেনা! আমি শুয়ে ছিলাম ঘরের দরজার পাশ  ঘেঁষে। আর দরজায় ছিল একটা বড়ো ফাটল। তা দিয়ে অসম্ভব ঠান্ডা হওয়া ঢুকছে আর আমার হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। আমার কাঁপুনি তে কিজার এর ঘুম ভেঙে যাবে মনে হচ্ছিলো। কারণ ও আমার পাশেই শুয়ে আছে! শেষে sleeping bag এর ভিতরে মাথাও ঢুকিয়ে দিলাম। তখন আস্তে আস্তে কাঁপুনি কমলো। ঘরের চালটা ভারি মজার ছিল।  নীল একটা plastic এর চাদর দেওয়া ছিল চালের এক পাশে। সেইখান দিয়ে চাঁদের আলো পরে মায়াবী নীল আলোতে ভরে দিয়েছিলো ঘরটাকে রাতের বেলায়! 

দ্বার গ্রাম এ আমাদের রাতের আস্তানা 

Earth Mover  পথ তৈরী করতে ব্যস্ত 






উর্থিং এর আগে ঝর্ণা 

উর্থিং এর আগে ঝর্ণা 

উর্থিং এ এসে গেছি 


১৪-০৫-২০১৪: 

আজ  আমরা ঊর্থিং থেকে নাগলিং গ্রামে যাবো। সকালে উঠে ওখানেই প্রথম দেখলাম কীড়া ঘাস বা ইয়েরসাগুম্বা  (Yarsagumba), যা সংগ্রহ করতে শয়ে শয়ে গ্রামের মানুষ গুলো পাহাড়ের ওপরে চলে যায়, যেখানে সদ্য বরফ গলছে। বরফ গোলে গেলে এই পোকা গুলো কে দেখতে পাওয়া যায়।  এর ঔষধী গুন্ বিরাট এবং নেপাল হয়ে সিংগাপুর এবং চীন এ চড়া দামে বিক্রি হয়ে থাকে! গুণমান ভালো হলে নাকি কেজি প্রতি ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়। এই অঞ্চলের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির ওপর এই পোকার অবদান অনেকটাই। সেই পোকা দেখে আমাদের জীবন ধন্য করে, পেট ভরে ছাতু খেয়ে রওনা দিলাম আমরা।

ঊর্থিং গ্রামের পর trekking trail  টি বেশ এবড়োখেবড়ো । কখনো নদীর ধারের Boulder Zone আবার কখনো চড়াই ভেঙে এগিয়ে চললাম আমরা। পথে কোথাও কোথাও Ice  Tongue পার হতে হলো।  আবার একটা বাড়ির ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়লো। এরপর আরো খানিকটা এগিয়ে গিয়ে পৌঁছে গেলাম শেলা নামের একটি গ্রামে। গ্রাম না বলে একটা ঘর বললেই সঠিক বলা হবে! কারণ পুরো গ্রাম তাই নিশ্চিন্হ হয়ে গেছে! একটা ঘর নতুন করে তৈরী হচ্ছে, এবং সেটাতে টুকটাক খাবার এবং চা এর বন্দবস্ত ও রয়েছে। সেখানে আমরা খানিক্ষন জিরিয়ে চা-টা খেয়ে নিলাম।

১১:৩০ এ সেলা ছেড়ে বেরোলাম। এরপর রাস্তা কিছু জায়গায় বিটকেল চড়াই আর কিছু জায়গায় boulder zone  পার হয়ে এগোতে হয়।  ধীরে সুস্থে সবার চলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক গুলো  কাঠের সেতু পার হয়ে শেষকালে একটা হালকা চড়াই ভেঙে যখন আমরা নাগলিং গ্রামে  পৌঁছলুম, তখন ঘড়িতে দুপুর ৩:১৫ বাজে। গ্রামে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো একটি school বাড়িতে। বাড়িটা সম্পূর্ণ পাথর সাজিয়ে তৈরী। এখানকার সব বাড়ি ই অবশ্য তাই! ঘরের চাল গুলো স্লেট পাথরের মতো পাথর দিয়ে ছাওয়া। অনেক পুরোনো এই অঞ্চলের গ্রাম গুলো। মানুষজন খুব সাধারণ ভাবে জীবন যাপন করে।  এখানে শীতের সময় এক ধরণের ফুলের চাষ হয়, যার রেনু গুলো কে পেশাই করে আটা বানিয়ে এরা তার রুটি খায়। নাগলিং এ এমন কিছু ঘর ও আছে যাদের ছেলে মেয়ে রা উচ্চশিক্ষা নিতে বাইরে থাকেন!  আমাদের স্কুল বাড়িটির ভেতরে একটা ঘরে রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করা হলো। বিকালে আড্ডা মেরে সময় কাটালাম। রাত্রে তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

ইয়েরসা গোম্বো / কীড়া ঘাস / কীড়া জড়ি 

উর্থিং এর আস্তানার মায়াবী নীল আলো 

Boulder ক্ষেত্র 

শেলা গ্রামের নতুন ভাবে তৈরী করা একটি বাড়ি/দোকান 


পুরোনো তুষার ধ্বস 





নাগলিং এর আগে বসার জায়গা 

নাগলিং গ্রামের শেষ চড়াই 

নাগলিং গ্রামের প্রবেশ পথ 

নাগলিং গ্রামে আমাদের আস্তানা 



১৫-০৫-২০১৪:

আজ সকালে উঠে তৈরী হয়ে নিলাম আমাদের যাত্রাপথের  শেষ গ্রাম দান্তু তে যাবার জন্য। স্কুলের সামনের উঠোন থেকে সামনের দৃশ্য টি খুব সুন্দর। উঠোনে আমাদের গোছানো sack গুলো কে রেখে বাকি মাল পত্র ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে দিলাম। ওই স্কুলের ৩ জন বাচ্চা মেয়ের সাথে খানিক্ষন গল্প হলো। ছাতু গুলে ব্রেকফাস্ট করে ৯:৩০ নাগাদ আমরা বেরিয়ে পড়লাম নাগলিং কে বিদায় জানিয়ে। নাগলিং এর পর থেকে পথ বেশিরভাগ টাই  বুগিয়ালের মধ্যে দিয়ে। খুব সহজেই এগিয়ে চললাম প্রাকৃতিক সভা উপভোগ করতে করতে। রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল। কিছুক্ষন পর পর দাঁড়িয়ে একটু গল্প করছি সবাই আর ছবি তুলে নিচ্ছি। খানিকটা চলার পর হালকা চড়াই ভেঙে ছায়া ঘেরা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ। জঙ্গল পার করে কিছুটা পথ হালকা চড়াই উঠে বেলা ১২ টা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম বালিং নামের একটি গ্রামের প্রবেশ দ্বার এর সামনে। গ্রামে ঢুকতেই মনে হলো হঠাৎ যেন একটু অন্য রকমের ভূমিরূপের মধ্যে এসে পড়লাম।গাছপালা একটু কম এখানে। ছবির মতো সাজানো গ্রাম। এখানে SSB Camp থেকে Satellite Phone এর মাধ্যমে কেউ চাইলে বাড়িতে কথা বলতে পারেন।সময় হিসাবে টাকা লাগে খুব সামান্যই।অনেকটা সময় কাটালাম এই গ্রাম টি তে। বালিং পার করে বুগিয়াল ধরে আরামসে এগিয়ে চলা। পথে আবার একটু দাঁড়ালাম মাঠের মতো একটা জায়গায়। আর সামান্য এগোলেই দানতু।

দুলকি চালে হেঁটে শেষের দিকে হালকা চড়াই ভেঙে শোন  গ্রাম পেরিয়ে একটু নিচের দিকে ঢাল বেয়ে নেমে ৪:১৫ নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম দানতু। গ্রামের নিচের দিকেই যদি বয়ে চলেছে। নদীর অপর পারেই দুগটু  গ্রাম। দানতু  তে  আমাদের থাকার বন্দবস্ত হলো গ্রাম পঞ্চায়েত এর একটি বাড়িতে। ভাড়া সামান্যই। বিকালে গ্রামের গলি গুলোতে একটু ঘুরে বেরিয়ে সময় কাটলো। রাত্রে কাকলি আর ভূপেন্দ্র মাইল খুব ঝাল দিয়ে খিছুড়ি রান্না করলো। বলল ঠান্ডায় ভালো জমবে। জমে না গেলেও, এত ঠান্ডা তেও আমাদের কান দিয়ে ধোঁয়া বেরিয়ে গেছিলো! যদিও সুস্বাদু ও হয়েছিল . . ☺️
নাগলিং এ সকালে 

নাগলিং থেকে হাঁটা শুরু 


একটু জিরিয়ে নেওয়া 


চড়াই ভাঙা 



বালিং গ্রাম এর প্রবেশ দ্বার 

বালিং গ্রাম



বালিং গ্রাম এর পর বুগিয়াল 


শোন গ্রামের ঘর 

দুগতু গ্রাম 


১৬-০৫-২০১৪:

রাত ২ টোয়ে উঠে পড়তে হলো।  তৈরী হয়ে বেরোতে হবে পঞ্চচুল্লি মূলশিবির এর পথে।  তাড়াতাড়ি সবাই কে ডেকে দেওয়া হলো। Tripod, Camera , জলের বোতল আর headlamp নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সবাই। সূর্যোদয়ের আগে পৌঁছতেই হবে সেখানে। অন্ধকারে সাবধানে এগিয়ে চললাম। বেশ ঠান্ডা। উষ্ণতা হিমাঙ্কের নিচে হওয়ায় শিশির পাথরের ওপর পরে জমে মারাত্মক পিছল হয়ে আছে। খুব সাবধানে দেখে পা রাখতে হচ্ছে। অসাবধান হলেই পা পিছলে বিপদ হতে পারে! খানিকটা পথ চড়াই ওঠার পর একটা দৃশ্য দেখে চোখ ভোরে গেলো। পূর্ণিমার চাঁদ পঞ্চচুল্লির ঠিক মাথার ওপর বিরাজ করছে। Tripod এ camera লাগিয়ে কয়েকটা ছবি নেবার চেষ্টা করলাম। কাকলির এই প্রথম Trek, ফলে বাঁধা সময় এর মধ্যে একই ছন্দে কিভাবে হেটে ওপরের দিকে উঠতে হয় তার অভিজ্ঞতা ওর নেই।  তাই মাঝখানে একটু মনোবল হারিয়ে ফেলেছিলো। শাম্ব আর আমি মিলে ওকে মানসিক বল দিলাম এবং এগোতে সাহায্য করলাম। 

অবশেষে ভোর ৫ টা নাগাদ আমরা পঞ্চচুল্লির মূল শিবিরে পৌঁছে গেলাম। একদিকে চাঁদ ধীরে ধীরে পঞ্চচুল্লির পিছনে অস্ত গেলো আর বিপরীত দিক থেকে, অর্থাৎ আমাদের পিছন দিক থেকে সূর্য উঠতে শুরু করে দিলো। অপরূপ এক মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি হলো। লালচে আগুন আভায় এক এক করে পঞ্চচুল্লির পাঁচটি শৃঙ্গের ওপর ছড়িয়ে গেলো বিবস্বান এর রক্তিম ছটা! মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখতে থাকলাম সেই ক্ষনে ক্ষনে পরিবর্তনশীল আলোর পর্বতের চূড়ায় চূড়ায় হাত বুলিয়ে যাওয়া! ধীরে ধীরে সাদা হয়ে উঠলো সমস্ত পর্বতমালা। আমাদের অসীম সৌভাগ্য যে আজ আমরা স্ফটিক স্বচ্ছ আবহাওয়া পেলাম! মন ভোরে ছবি তুললাম আমরা।

এবার পঞ্চচুল্লির লোককথা তা বলে ফেলি! কথিত আছে, পঞ্চ পান্ডব আর দ্রৌপদী যখন মহা প্রস্থানের পথে যাচ্ছিলেন তখন এই স্থানে তারা বিশ্রাম নেবার জন্য থামেন। দ্রৌপদী তখন পাঁচ পান্ডবের খাবার বানাবার জন্য পাঁচ টি উনুন বা চুল্লি তৈরী করছিলেন। সেই পাঁচ টি উনুন ই হলো এই পঞ্চচুল্লি! আমার ধারণা সবচেয়ে বড়ো টা ভীম এর!

মূল শিবির এ অনেকটা সময় কাটিয়ে আমরা ফায়ার আসতে থাকি দানতু এর দিকে। আজ ই  আমাদের নেমে যেতে হবে নাগলিং। 


পর্বত শিখরে চাঁদের মুকুট 










আমাদের দল 

হিমানী ক্ষেত্র 

ফেরার পালা 

দুগতু গ্রাম 

মুক্ত থাকার আনন্দ 

উপরে আমাদের আস্তানা দেখা যাচ্ছে 

কারুকাজ করা ঘর 

গ্রামের মানুষ 

বাহারি কারুকাজ করা দরজা জানালা 

এনার সাথে ফেরার পথে দেখা !




১৭-০৫-২০১৪:

আজ আমরা সরাসরি দার এ নেমে যাবো। ট্রেক এর শুরুতে সময় নষ্ট হওয়াতে আমাদের একদিনে একটু  বেশি পথ নামতে হবে।  তবে এসব trekking এর অঙ্গ। এরকম হয়েই থাকে। তবেই না Adventure! দার এ ফিরে আমরা আবার সেই ভাঙা বাড়িতেই রাত কাটাই। এতকিছুর পরেও আমরা সফল ভাবে ট্রেক টি সম্পূর্ণ করতে পারলাম ভেবে সবারই মন খুশি। এবার বাড়ি ফেরার পালা। বিদায় ডারমা উপত্যকা। আবার দেখা হবে। 

পুনঃ : আমার এই Blog টি যদি কেউ VLOG অর্থাৎ YouTube Video রূপে দেখতে চান, তাহলে নিচের দেওয়া Link এ Click করতে পারেন। 

DARMA VALLEY VIEDEO LOG on  YouTube  



*****************X *****************


মাননীয় পাঠক-পাঠিকা, ধৈর্য ধরে আমার এই লেখা পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। লেখা টি পরে কেমন লাগলো তা comment করে জানালে ভবিষ্যতে উন্নত ভাবে গল্প উপস্থাপন করতে সুবিধা হবে। আগামী গল্প গুলি পড়তে হলে  Blog এ চোখ রাখবেন।

ধন্যবাদান্তে,
বিশ্বরূপ।

প্রকৃতি কে ভালোবাসুন .. প্রকৃতি কে রক্ষা করুন ..

ধন্যবাদ